ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কে কিছু কথা।
আলহামদুলেল্লাহ , সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ রব্বুল আলামীন এর জন্য। দুরুদ ও সালাম নাযিল হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর।অতঃপর,প্রথমেই বলে নিচ্ছি আমি হানাফী নই, হানাফী মাযহাব অথবা ফেকাহ এর অনুসারী আমি নই। একজন মুসলিম হিসাবে আমি এই আর্টিকেলটি লিখছি। ইমাম আবু হানিফা কিরুপ ব্যাক্তি ছিলেন, তার জ্ঞান কিরুপ ছিল, এসব নিয়ে আমাদের সমাজে দু’ধরনের কথা শোনা যায়, তাই আমি এখানে চেষ্টা করব নিরপেক্ষ ভাবে তার পদকে স্পষ্ট করার জন্য। ইমাম আবু হানিফার পুরো নামঃ নু’মান বিনছাবিত বিন যুতই আল-খাযযায আল-কুফী।উপনামঃ আবু হানিফা।জন্মঃ ৮০ হিজরিতে কুফা নগরীতে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। [তারিখে বাগদাদঃ ১৩/৩২৫]শিক্ষা জীবনঃ শিক্ষা জীবন শুরু করে তিনি কালাম শাস্ত্র ও তর্কবিদ্যা শিক্ষা লাভ করে ভ্রান্ত মতবাদের প্রতিবাদে তর্ক সংগ্রাম চালিয়ে তার্কিক হিসাবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু এ তর্ক চর্চা কোরআন,সুন্নাহ ও ফিকাহ শাস্ত্রে বিঘ্নতা সৃষ্টি করলে তর্ক চর্চা বর্জন করে কোরআন,সুন্নাহ ও ফিকাহ চর্চায় মনোনিবেশ করেন। [মানাকীব আবী হানিফা লিল মাক্কী-৫৪পৃঃ]ইমাম আবু হানিফা তাবেয়ী ছিলেনঃ ছোট বয়সে তিনি আনাস বিন মালেক(রাদিয়াল্লাহু আনহু) এর সাক্ষাত লাভ করেন, কিন্তু তার কাছ থেকে তেমন কিছু শিক্ষা গ্রহন করতে পারেননি, কারন তিনি প্রাথমিক যুগে ব্যবসায়ী কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। [উকুলুদ জিমান, পৃঃ ১৬০] জ্ঞান গবেশনায় ইমাম আবুহানিফাঃ ইমাম কাবীসাহ বিন উকবা(রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ “ইমাম আবু হানিফা প্রথম পর্যায়ে তর্ক বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে বিদ’আতী বাতিল পন্থীদের সাথে তর্কে লিপ্ত হন, এভাবে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী তার্কিকে পরিনত হন। অতঃপর তিনি তর্ক চর্চা বর্জন করে ফিকাহ ও সুন্নাহ চর্চায় লিপ্ত হন এবং একজন ইমামে পরিনত হন” [উকুলুদ জিমান, পৃঃ ১৬১] ফিকাহ শাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফাঃ প্রখ্যাত ইমাম, ইমাম আব্দুল্লাহ ইবন মুবারাক(রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ “ইমাম আবু হানিফা স্বীয় যুগে ফিকাহ শাস্ত্রেঅপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাক্তি ছিলেন” [সিয়ারুআলামিল্লুবালা, পৃঃ ৬/৪০৩]
এছাড়াও আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আহ এর সকল ইমামগন ইমাম আবু হানিফার ফিকহি জ্ঞানের কথা স্বীকার করেছেন। হাদীস বর্ণনায় ইমাম আবুহানিফাঃ প্রখ্যাত মুহাদ্দিস, ইমাম যাহাবী(রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ “ইমাম সাহেব(ইমাম আবু হানিফা) হাদিসের শব্দ ও সনদ বা সুত্ররপ্ত ও যাবত করনে গুরুত্ব দিতে পারেন নি, তার গুরুত্ব ছিল কোরআন ও ফিকাহ শাস্ত্রে, বস্তুতঃ সকল ব্যাক্তির এমনই অবস্থা হয়, এক বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে অপর বিষয় ঘাটতি হয়ে যায়” [মানাকিব আবী হানীফাহ ও সাহিবাইহি লিয যাহাবী, পৃঃ ২৮] কিছু কিছু মুহাদ্দিসগন ইমাম আবু হানিফাকে হাদীস শাস্ত্রে দুর্বল আবার কেউ কেউ তাকে নির্ভরযোগ্যও বলেছেন, তবে ফিকাহশাস্ত্রে ইমাম আবু হানিফা ছিলেন একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র । কিয়াস ও ইমাম আবুহানিফাঃবর্তমানে কিছু মানুষ বলেন যে,ইমাম আবু হানিফা ছিলেন কিয়াস এর ইমাম, কিয়াস এর প্রবর্তক আরও অনেক কিছু, তারা আরও বলেন, ইমাম আবু হানিফা হাদীস পাওয়া সত্ত্বেও কিয়াস করতেন আর হাদীস অমান্য করতেন।তাদের কথার জবাবে আমি শায়খ উল ইসলাম ইমাম তাকী উদ্দীন আহমাদ ইবন তাইমিয়্যার একটি কথা বলবো, তা হলঃ “সর্বজনস্বীকৃত কোনো ইমাম, রাসুলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সুন্নাতের, তা হোক ছোট বা বড় হোক, খেলাফ করেন নি” [ইমাম ইবন তায়মিয়্যাহ এর রাফ’উল মালাম, সম্মানিত ইমামদের সমালোচনার জবাব, পৃঃ ৪]ইমামদের মধ্যে ফিকহি ইখতিলাফ ছিল, তারা প্রত্যেকেই দলীলের উপর নির্ভর করেই ইজতিহাদ করেছেন, পূর্বের কোন গ্রহণযোগ্য ইমাম,মুহাদ্দিস,ফাকীহ সম্মানিত ৪ ইমামের কাউকেও এরুপ অপবাদ দেন নি যে,তাদের মধ্যে থেকে কেউ হাদীস পাওয়া সত্ত্বেও হাদীস পরিত্যাগ করেছেন আর কিয়াস করেছেন।শায়খ উল ইসলাম ইমাম তাকীউদ্দীন আহমাদ ইবন তাইমিয়্যা একটি কিতাব পর্যন্ত লিখেছেন রাফ’উল মালাম নামে যাতে তিনি সম্মানিত ইমামদের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন।আমি ব্যাক্তিগত ভাবে ইমাম আবু হানিফার ফেকাহর অনুসারী নই, কিন্তু আমি একজন মুসলিম হিসাবে ইমাম আবু হানিফার নামে মিথ্যাচার এর জবাব অবশ্যই দিব,যারা বলেন যে ইমাম আবু হানিফা ছিলেন কিয়াস এর ইমাম, কিয়াস এর প্রবর্তক তিনি হাদীস পাওয়া সত্ত্বেও কিয়াস করতেন আর হাদীস অমান্য করতেন তাদের কাছে আমার একটি প্রশ্নঃ
ধরে নিলাম যে, ইমাম আবু হানিফা কিয়াস করে মত দিতেন আর হাদীস অমান্য করতেন, কিন্তু ইমাম সুফইয়ান আছ-ছাওরী(রাহিমাহুল্লাহ) একজন মুহাদ্দিস ও মুজতাহিদ ছিলেন, ইমাম সুফইয়ান আছ-ছাওরী কিয়াস করতেন না বরং হাদীসের অনুসরন করতেন,এখন আমার প্রশ্ন হলঃ ইমাম আবু হানিফা কিয়াস করে মত দিতেন আর হাদীস অমান্য করতেন আর সুফইয়ান আছ-ছাওরী কিয়াস করতেন না বরং হাদীসের অনুসরন করে মত দিতেন, তাহলে এই দু’জনের দেওয়া ফাতওয়ার মধ্যে এতো মিল কেন?আপনারা(যারা বলেন যে, ইমাম আবু হানিফা ছিলেন কিয়াস এর অনুসারী) বলেন যে, ইমাম আবু হানিফা আহলুল রায়, আহলুল কিয়াস ছিলেন আর ইমাম সুফইয়ান আছ-ছাওরী আহলুল হাদীস ছিলেন,তাহলে কেন তাদের দু’জনের প্রায় ৯৯% ফাতওয়া একই? ইমাম আবু হানিফার মতে- ওজুতে নাকে পানি না দিলেও ওজু হবে।ইমাম সুফইয়ান ছাওরীর মতে-ওজুতে নাকে পানি না দিলেও ওজু হবে।ইমাম আবু হানিফার মতে-লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওজু ভঙ্গ হয় না।ইমাম সুফইয়ান ছাওরীর মতে- লজ্জাস্থান স্পর্শ করলে ওজু ভঙ্গ হয় না।ইমাম আবু হানিফার মতে- উটের গোস্ত খেলে ওজু ভঙ্গ হয় না।ইমাম সুফইয়ান ছাওরীর মতে- উটের গোস্ত খেলে ওজু ভঙ্গ হয় না।ইমাম আবু হানিফার মতে- সালাতে রুকুর আগে ও পরে রাফুল ইয়াদিন করতে হয় না।ইমাম সুফইয়ান ছাওরীর মতে-সালাতে রুকুর আগে ও পরে রাফুল ইয়াদিন করতে হয় না।ইমাম আবু হানিফার মতে- ইকামতের কালেমা গুলো ২ বার করে উচ্চারণ করতে হবে।ইমাম সুফইয়ান ছাওরীর মতে-ইকামতের কালেমা গুলো ২ বার করে উচ্চারণ করতে হবে।ইমাম আবু হানিফার মতে- সফরে কসর করবে ১৫ দিন।ইমাম সুফইয়ান ছাওরীর মতে- সফরে কসর করবে ১৫ দিন।ইমাম আবু হানিফার মতে- সালাতুল কুসুফ ২ রাকাত ২ রুকুতে ও ৪ সিজদায়।ইমাম সুফইয়ান ছাওরীর মতে-সালাতুল কুসুফ ২ রাকাত ২ রুকুতে ও ৪ সিজদায়।এখানে আমি মাত্র ৭ টি মাসয়ালা উল্লেখ্য করলাম যেখানে ইমাম আবু হানিফা ও ইমাম সুফইয়ান ছাওরী একমত, এরকম হাজারটা মাসয়ালা রয়েছে যেখানে এই দু’ইমাম একমত, তাহলে কিভাবে ইমাম আবু হানিফা কিয়াসের অনুসারী আর ইমাম সুফইয়ান ছাওরী হাদিসের অনুসারী?অর্থাৎ, এই সম্মানিত দু’জন ইমাম ছিলেন হাদীসের অনুসারী। তবে তাদের ফাতওয়ার বিরুদ্ধেও অন্যান্য ইমামগন রয়েছেন ।
মূলত ফিকহি ইখতিলাফ সাহাবীদের জমানা থেকেই রয়েছে। যেমনঃ আব্দুল্লাহ ইবন মাস’উদ(রাদিয়াল্লাহু আনহু) সাড়া বছর বি’তর সালাতে কুনুত পরতেন আর আলী(রাদিয়াল্লাহু আনহু) শুধু মাত্র রমজানের শেষ ১৫ দিন বি’তর সালাতে কুনুত পরতেন আবার আব্দুল্লাহ ইবন উমার(রাদিয়াল্লাহু আনহু) কখনই বিতর সালাতে কুনুত পরতেন না।জেনে রাখা উচিত, মুজতাহিদগন ভুল ফাতওয়া দিলেও একটি সাওয়াব পাবেন, কিন্তু আমরা সাড়া জীবন তাদের সমালোচনা করলেও কি ১টি নেকি পাবো? উপরে উল্লেখিত ৭ টি মাসয়ালার একটিও আমি মানি না, বরং তাদের বিপরীত মত আমি মানি। ইমাম আবু হানিফা সম্পর্কেগ্রহণযোগ্য কিছু শ্রেষ্ঠ উলামাদের মন্তব্যঃ১. প্রখ্যাত মুজতাহিদ ও ফাকীহ,ইমামে মুহাদ্দিসীন, ইমামে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আত ইমাম আহমাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন হাম্বল আশ-শাইবানী আল-বাগদাদী(রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ “ইমাম সাহেব(ইমাম আবুহানিফা) শিক্ষা, আল্লাহ ভীরুতা ও আখীরাত মুখী হিসাবে এক বিশেষ অবস্থানে ছিলেন,আল্লাহ তাকে বিশেষ রহম করুন” [উকুলুদজিমান, পৃঃ ১৯৩] ২. প্রখ্যাত মুহাদ্দিস,ফাকীহ ওমুজতাহীদ, শাইখ উল ইসলাম ইমাম তাকী উদ্দীন আহমাদ আব্দুল হালীম ইবন তাইমিয়্যা(রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ “যদিও মানুষেরা ইমাম আবু হানিফার কিছু বিষয়ে বিরোধিতা করেছেন ও অপছন্দ করেছেন, কিন্তু তার জ্ঞান ও বিবেক বুদ্ধিতে কারও কোনরূপ সন্দেহ নেই” [মিনহাজুম সুন্নাহ, পৃঃ ২/৬১৯]
৩. প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাকীহ, ইমাম যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেনঃ “ইমাম আবু হানিফা একজন বিশিষ্ট আলেম,গবেষক, সাধক ও ইমাম ছিলেন। তিনি বড় ব্যাক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, রাজা-বাদশাহদের কোন পুরস্কার গ্রহন করতেন না” [তাযকিরতুল হুফফাজ, পৃঃ ১/১৬৮] ইমাম আবু হানিফা ১৫ই শাবান ১৫০ হিজরিতে ৭০ বছর বয়সে মৃত্যুবরন করেন। ইমাম আবু হানিফা এর উপর আল্লাহ রহম করুক, তার সম্মান বারিয়ে দিক, তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুক, আমীন।
No comments:
Post a Comment