সিরিয়াঃ এক বছরে আগের চেয়ে আরো খারাপ হয়েছে।
চার বছর আগেও ৩৫ বছর বয়সি আব্দুলের জীবনটা এ রকম ছিল না। সিরিয়ায় থাকতেন তিনি। কাজ করতেন একটি চকোলেট কারখানায়। স্ত্রী , মেয়ে রিম এবং ছেলে আবদেলিল্লাহকে নিয়ে সুখেই কাটছিল দিন। কিন্তু বাদ সাধল সিরিয়ায় ছড়িয়ে পড়া সংঘর্ষ। বন্ধ হয়ে গেল সেই কারখানাও। পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সুস্থ ভাবে বাঁচার জন্য লড়াই করতে। ইচ্ছে ছিল, কোনও ভাবে মিশর পৌঁছনো। কিন্তু স্ত্রী জোরাজুরি করেছিলেন সিরিয়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য। আব্দুল রাজি না হওয়ায় স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। এর পর আব্দুলের কয়েক জন বন্ধু মিলে তাঁকে লেবাননে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। সেই মতোই তিনি চলে আসেন বেইরুটে। সেখানেও চকোলেট কারখানায় কাজ নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোনও কারখানায় তাঁকে কাজ দেওয়া হয়নি। ফলে কোনও উপায় না দেখেই তিনি রাস্তাঘাটে কলম ফেরি করে বেড়াতে শুরু করেন।
হ্যাঁ, এই হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান বাস্তবতা। অন্যদের মত এককালের সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর পরিচয়ও এখন একটাই- শরণার্থী। কেন তাদের এই পরিণতি? শুরুতে আসাদের পতনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক সংঘাত, সংঘর্ষ। তাকে পুঁজি করে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধ থেকে এখন সেখানে চলছে আইএস-পশ্চিমাদের ইঁদুর-বেড়াল খেলা। এসব মিলে আজ সুখী একটি দেশের মানুষ প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে। প্রাণ যাচ্ছে শিশুদের। গৃহহীন হচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। কোন স্বপ্ন নেই, অদূরভবিষ্যতে তাদের মুক্তি মিলবে এমন কোনও সম্ভাবনা নেই।
গোলযোগ বাঁধার সময় তারাও এ থেকে বড় কিছু হবে বলে ধারণা করেনি। যার কারণে সবাই আত্মকেন্দ্রিক হয়ে অপেক্ষা করেছিল একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে মনে করে। আজকে আমরাও কি অনুরূপ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বসে নেই? আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়েই কিলাকিলি করে যাচ্ছি। বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের রাষ্ট্র পর্যন্ত নিরাবেগ, নিরুদ্বিগ্ন। অন্তত সাধারণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কোন লক্ষণ স্পষ্ট নয়। ওদিকে আইএস সারা পৃথিবীর জন্যই যে হুমকিজনক তা আমরা চিন্তা করছি না। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পৃথিবীর বহুলাংশে আইএস ছড়িয়ে পড়বে, পাল্টে যাবে বিশ্বপরিস্থিতি। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই উপমহাদেশে পৌঁছে যাবে তারা সেই ঘোষণাও দিয়ে রেখেছে। সেই পরিস্থিতি ঠেকাতে আমাদের কোন ভাবনা নেই। দলাদলি, হানাহানি, দখল, ঘুষ- লুটপাট, প্রতিপক্ষকে নির্মূলের রাজনীতি চলছে সর্বোতভাবে। ফলে স্বাভাবিক পরিবর্তনে আস্থা হারিয়ে নিরূপায় জনগণের মধ্যে একটা বিরাট অংশ এখন আইএস বা এই জাতীয় উগ্রপন্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ছে। তারা এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ভিন্ন শক্তিকে স্বাগত জানাতে কুণ্ঠাবোধ করবে না তারা। এ ধরনের লক্ষণ ইতোমধ্যেই ফুটে উঠেছে। কিন্তু তারা জানে না এর ফলে তারা কড়াই থেকে চুলোয়ই পড়বে। একটা সিরিয়া, একটা ইরাক, একটা আফগানিস্তান হয়ে উঠবে এই বাংলাদেশসহ পুরো উপমহাদেশ। তখন এদেশীয় সুখী মানুষ, রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান, নেতা, সাংসদদের কেউই আর রেহাই পাবেন না। যাবেন কোথায়? ইউরোপ-আমেরিকাও স্থান দেবে না। কারণ তারা নিজেরাই তখন হুমকির মুখে থাকবে।
সুতরাং বিশ্বপরিস্থিতির দিকে তাকিয়ে আমাদেরকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা এ বিভক্তি সৃষ্টি করার পঁচা রাজনীতি, লুটপাটের অর্থনীতি, লুণ্ঠন, মানুষকে কথা বলার অধিকার বন্ধ করার প্রচেষ্টা বন্ধ করব নাকি সিরিয়ানদের দুর্বিষহ অবস্থাকে আলিঙ্গন করব। এই মুহূর্তে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সব ধরনের মত-পার্থক্যকে আড়াল করে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করা, যাতে অন্ততপক্ষে কোনভাবেই মানুষ আইএসের দিকে ঝুঁকে না পড়ে। দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারলে আইএস এবং সাম্রাজ্রবাদী শক্তিগুলো কোন অজুহাত খুঁজে পাবে না এদেশে আসন গাড়ার। মনে রাখতে হবে, সাম্রাজ্যবাদীরা আগে আইএসকে পাঠাবে পরে তাদেরকে মোকাবেলা করার নাম করে নিজেরা এসে পৌঁছাবে। কিন্তু আইএসের প্রবেশকে ঠেকাতে পারলে কিছুতেই সাম্রাজ্যবাদীরা আসতে পারবে না এবং আমাদের সুখ-সমৃদ্ধিকে ধ্বংস করে আমাদেরকে শরণার্থী শিবিরে পাঠাতে পারবে না। কিন্তু আমরা কি আইএস আসার জন্য, তাদেরকে সাধারণ মানুষ কর্তৃক স্বাগত জানানোর প্রক্রিয়াটি তৈরি করে দিচ্ছি না?
No comments:
Post a Comment