বোরকা দিয়ে মুখ একেবারে ছাপিয়ে রাখা কি আল্লাহর আদেশ না রসুলের আদেশ?
সৌদি আরবে এক প্রাক্তন পুলিশ সদস্য তার স্ত্রীকে মুখ খোলা রেখে টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়েছেন এবং তিনি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছেন এটাই ইসলামের সঠিক হেজাব। এ নিয়ে রক্ষণশীল সৌদীদের মধ্যে নাকি তুমুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি খবর আমাদের সময়ের সাবেক সাইটে প্রকাশিত হয়েছে (প্রথম কমেন্টে লিংক)। সেখানে দেখা গেছে একদল বাঙালি মুর্খেরা পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক জুড়ে দিয়েছে। মুখ ঢেকে রাখা হেজাবের সমর্থকরা ও মুখ খোলা হেযাবীরা উভয়েই সেখানে হেজাব খুলে গালাগালি করছেন সমান তালে। অবাক বিষয়, এতে কিন্তু তাদের হেযাবের লংঘন হচ্ছে না!
মুখ ঢেকে হেযাবের সমর্থক এদেশেও কম নয়। কিছু মোল্লাশ্রেণির অতি মুসলিমদেরকে দেখা যায় তারা নিজের স্ত্রীকে তো প্যাকেট বন্দী করিয়েছেনই, পাশাপাশি তাদের মেয়ে শিশু, যাদের বয়স পাচ, ছয় কিংবা সাত, তাদেরকেও অনুরূপভাবে হেযাব শেখাচ্ছেন। এটা নাকি আগে থেকেই অভ্যস্ত করা! ফেসবুকেও মাঝে মাঝে বাচ্চাদের হেযাব করা এ সংক্রান্ত ছবি দিয়ে লাইক চাওয়া হয়। আর এতে যথেষ্ট ‘সুবাহান্নাল্লা’ কমেন্ট পড়তে দেখা যায়। মূল কথা হচ্ছে হেযাব সংক্রান্ত এই বিকৃতির কারণ হচ্ছে হেযাবের প্রকৃত উদ্দেশ্য না জানা। এ জন্যই দেখা যায় বিগত যৌবনা দাদী, নানীরা আপাদমস্তক কাপড়ে আবৃত হয়ে হাস-ফাস করছেন আর পাশে তাদের নাতনীরা রয়েছেন অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায়।
যারা হেযাব মুখ ঢেকে করতে হবে বলে লাফালাফি করে তাদের জন্য সূরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতই যথেষ্ট হওয়া উচিত ছিল। আয়াতটি হচ্ছে ‘হে নবী! আপনি আপনার পতœীগণকে ও কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে। ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল পরম দয়ালু।’ কিন্তু এতে তাদের পেট ভরবে না। আল্লাহর দেওয়া সীমা থেকে এরা ‘বেশি মুসলিম’ হতে চায়। খেয়াল করে দেখুন আল্লাহ এখানে স্পষ্ট বলেছেন চাদরের কিয়দংশ যেন নিজেদের উপর টেনে নেয় এবং এতে তাদেরকে চেনা সহজ হবে, উত্তক্ত করা হবে না। প্রাচীন আরবে এখনকার নাতনীদের মত কাপড় পেছনে ফেলত। আল্লাহ তাদেরকে সামনে ফেলতে বলেছেন।
আল্লাহ ও তাঁর রসুলের থেকে বেশি বুঝা ও বেশি ধার্মিক হওয়াটাই হচ্ছে বাড়াবাড়ি। একদিন আল্লাহর রসুলকে জানানো হলো যে কিছু আরব রোযা রাখা অবস্থায় স্ত্রীদের চুমো দেন না এবং রমযান মাসে সফরে বের হলেও রোযা রাখেন। শুনে ক্রোধে বিশ্বনবীর (দঃ) মুখ-চোখ লাল হোয়ে গেলো এবং তিনি মসজিদে যেয়ে মিম্বরে দাঁড়িয়ে আল্লাহর হামদ বলার পর বললেন- সেই সব লোকদের কী দশা হবে যারা আমি নিজে যা করি তা থেকে তাদের বিরত রেখেছে? আল্লাহর কসম তাদের চেয়ে আমি আল্লাহকে বেশি জানি এবং বেশি ভয় করি [হাদীস-আয়েশা (রাঃ) থেকে বোখারী, মুশলিম, মেশকাত]। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে এই অতি মুসলিমরা আজকে আল্লাহর দেওয়া সীমা ভেে ঙ্গ রসুলের চেয়েও বেশি ইসলাম পালন করতে চায় এবং বেশি বুঝে থাকে।
এর কারণও রয়েছে। ইসলামের অন্যান্য মৌলিক বিষয়গুলো তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। সেগুলো প্রতিষ্ঠা করাটা একটু কঠিন এবং এতে তাদের স্বার্থহানী ঘটে। যে সুদপ্রথা, ঘুষ খাওয়া, মিথ্যা বলা, ওয়াদা ভঙ্গ করা, আমানতের খেয়ানত করাকে আল্লাহ কঠিনভাবে বারণ করেছেন তারা সেগুলো অবলীলায় করে যায়। তাদের এই দুর্বলতাকে ঢাকতে গিয়ে এরা পর্দা করার উপর, পায়জামা-পাঞ্জাবী অর্থাৎ বাহ্যিক বিষয়গুলোর উপর অধিক জোরারোপ করেছে। কারণ ওগুলো দেখা যায়। ওগুলো দেখিয়ে ভাল মানুষ সাজা যায়, মানুষকে ধোকা দেওয়া যায়। কিন্তু সুদ না খাওয়া, ষুষ না খাওয়া, সত্য বলা, প্রাণ দিয়ে ওয়াদা রক্ষা করা, আমানত রক্ষা করার কাজগুলোতে পার্থিব ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা থাকে এবং এগুলো দেখাও যায় না।
তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম যে মুখ ঢেকে পদা করাই ঠিক। কিন্তু তারা মুখ ঢেকে পর্দা করার জন্য যতটা উৎসাহী ততটাই অনুৎসাহী নারীদের উন্নয়ন ঘটাতে। এই বাংলাদেশেই বহু নারী রয়েছেন যারা এই গোড়াপন্থীদের বেধে দেওয়া সীমা অনুযায়ী যতটুকু কাপড় দরকার হয় ততটুকু কাপড় যোগাতেও সক্ষম নয়। অনেকে অতিরিক্ত একটা ব্লাউজও পড়ে না, অতটুকু কাপড় যোগার করাও হয়ে উঠে না- এমন বহু নারীকে আমি দেখেছি। এদের বাড়িতে আওতা বা বেড়া দেওয়ার সাধ্যও এদের নেই। এরা ঝোপ-ঝাড়ে প্রস্রাব-পায়খানা করে। প্রকাশ্য স্থানে, নদীতে, পুকুরে এরা গোসল করে। ইটের ভাটায়, রাস্তায় পুরুষের মত পরিশ্রম করে। গোড়াদের বেধে দেওয়া নির্ধারিত পোশাক পরলে তাদের দ্বারা আর কাজই করা সম্ভব নয়। অতি গোড়ারা সেই পিছিয়ে পড়া নারীদের উন্নয়নের জন্য কোন কথা বলে না, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য এদের কোন পদক্ষেপও নেই। তাই তাদের উচিত আগে নারীদেরকে সেই পরিমাণ স্বাবলম্বী করা, তারপর মুখ খোলা বা মুখ ঢাকা নিয়ে বিতর্ক করা।
অবাক করা বিষয় হচ্ছে এই যে এই পিছিয়ে পড়া মানুষগুলোর মতই অভাবী আর দরিদ্র ছিলেন রসুলের আসহাবগণ। তারা ঠিকমত সাজদা দিতে পারতেন না নিজেদের সতর/লজ্জাস্থান প্রকাশ হয়ে পড়তো বলে। অনেকের একটার অতিরিক্ত জামাই ছিল না। এ সংক্রান্ত বহু ঘটনা হাদিস থেকে তুলে ধরা যায়। উদৃত্তি দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। যাদের হৃদয় খোলা তাদের জন্য এর বেশি প্রয়োজন নেই। কিন্তু সেই আসহাবগণ কোথাও আটকেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। তাঁরাই আজ এবং ভবিষ্যত উম্মাহর জন্য অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। অথচ আজকের অতি মুসলিমরা যে দৈর্ঘের পোশাক পরেন আর মানুষকে সেই দৈর্ঘের পোশাকের নসিহত করেন তা সেই যুগের খলিফাদেরও ভাগে পড়ত না। বেশি পড়লেই জনতার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হত। উদাহরণ, খলিফা ওমরের (রা.) ঘটনা।
No comments:
Post a Comment