মক্কার তৎকালীন মোশরেকদের সঙ্গে বর্তমানের বিকৃত এসলামের মিল
এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী
বর্ত্তমানে বিকৃত এসলামের অনুসারীদের মধ্যে প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাস অর্থাৎ আকীদা হোচ্ছে এই যে, বিশ্বনবী মোহাম্মদ (দঃ) যাদের মধ্যে আবির্ভূত হোয়েছিলেন অর্থাৎ তদানিন্তন আরববাসীরা আল্লাহকে বিশ্বাস কোরতো না, তাদের আল্লাহর ওপর ঈমান ছিলো না। এই ধারণা সম্পুর্ণ ভুল। তখনকার আরবরা বিশ্বাস কোরতো যে তারা আল্লাহর নবী এব্রাহীমের (আঃ) উম্মাহ। তারা নিজেদের ‘হানীফ’ বোলতো। হানীফ অর্থ একাগ্র। অর্থাৎ তারা তওহীদ এবং এব্রাহীমের (আঃ) একাগ্র অনুসারী। সুতরাং তদানিন্তন আরববাসীরা আল্লাহকে তেমনই বিশ্বাস কোরতো যেমন বর্ত্তমানের পৃথিবীময় মোসলেম বোলে পরিচিত লোকেরা এবং অন্যান্য ধর্মের লোকেরা বিশ্বাস করে। ঐ আরবরা আল্লাহকে সৃষ্টিকর্ত্তা বোলে, পালনকারী বোলে বিশ্বাস কোরতো, নামাজ পোড়তো, কাবা শরীফকে আল্লাহর ঘর বোলে বিশ্বাস কোরতো, ঐ কাবাকে কেন্দ্র কোরে বাৎসরিক হজ্ব কোরতো, কোরবানী কোরতো, রোযা রাখতো, আল্লাহর নামে কসম কোরতো, নিজেদের সন্তানদের নাম আব্দুল্লাহ (আল্লাহর দাস) রাখতো, এমনকি বর্ত্তমান সময়ের ‘মোসলেমদের’ মতো খাত্নাও কোরতো। শুধু তাই নয়, প্রয়োজনীয় দলিল, বিয়ে শাদীর কাবিন ইত্যাদি সমস্ত কিছু লেখার আগে আমরা যেমন বেসমেল্লাহ লেখি তেমনি তারাও আল্লাহর নাম লিখতো। তারা লিখতো বেস্মেকা আল্লাহুম্মা, অর্থাৎ তোমার নাম নিয়ে (আরম্ভ কোরছি) হে আল্লাহ। নবুয়াত পাবার আগে মহানবীর সঙ্গে আম্মা খাদীজার (রাঃ) বিয়ের যে কাবিন লেখা হোয়েছিলো তা লিখেছিলো আরবের লোকেরা যাদের আমরা এখন কাফের মোশরেক বলি এবং তা তারা শুরু কোরেছিলো আল্লাহর নাম দিয়ে। তওহীদের ডাক দেবার ‘অপরাধে’ আল্লাহর রসুলকে তাঁর পরিবার পরিজন ও আসহাবসহ মক্কার বাইরে উত্তপ্ত উপত্যকায় নির্বাসন দেবার জন্য যে বিজ্ঞপ্তি মোশরেক কোরায়েশ নেতারা সর্বসাধারণের জানার জন্য পবিত্র কাবার দরজার ওপর ঝুলিয়ে দিয়েছিলো সে বিজ্ঞপ্তির প্রথমেই তারা লিখেছিলো- বেসমেকা আল্লাহুম্মা।
হুদায়বিয়ার সন্ধিপত্র লেখার সময় আলী (রাঃ) যখন ‘বেসমেল্লাহের রহমানের রহিম’ দিয়ে আরম্ভ কোরলেন তখন মোশরেক কোরায়েশদের প্রতিনিধি সুহায়েল বিন্ আমর প্রতিবাদ কোরে বোললো, আমরা এ রকম কোরে লেখি না, আমরা যে ভাবে আল্লাহর নাম লেখি ঐ ভাবে লিখতে হবে, অর্থাৎ বেস্মেকা আল্লাহুম্মা। তখন আল্লাহর রসুলের আদেশে আলী (রাঃ) ঐ ভাবেই লিখলেন। এগুলো ঐতিহাসিক প্রমাণ।আরবের মোশরেকরা যে আমাদের মতই আল্লাহয় বিশ্বাসী ছিলো এ কথায় সাক্ষ্য স্বয়ং আল্লাহ। কোর’আনে তিনি তাঁর রসুলকে বোলছেন- তুমি যদি তাদের (আরবের মোশরেক, কাফের অধিবাসীদের) জিজ্ঞাসা করো, আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি কোরেছেন? তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- সেই সর্বশক্তিমান, মহাজ্ঞানী (আল্লাহ) (কোর’আন- সুরা যুখরুফ- ৯)। অন্যত্র বোলেছেন- তুমি যদি তাদের প্রশ্ন করো আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি কোরেছেন এবং কে সূর্য্য ও চন্দ্রকে তাদের (কর্ত্তব্য কাজে) নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণ কোরছেন, তবে তারা নিশ্চয়ই জবাব দেবে- আল্লাহ (কোর’আন- সুরা আনকাবুত- ৬১)। আল্লাহ আবার বোলছেন- যদি তাদের প্রশ্ন করো, কে এই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি কোরেছেন, তবে তারা নিশ্চয়ই জবাব দেবে আল্লাহ (কোর’আন- সুরা লোকমান- ২৫)। আল্লাহ তাঁর নবীকে আবার বোলছেন ঐ মোশরেকদের প্রশ্ন কোরতে (পানির অভাবে শুকিয়ে, ফেটে যেয়ে) মাটি যখন মরে যায়, তখন আকাশ থেকে পানি বর্ষণ কোরে কে তাকে পুণর্জীবন দান করেন- তবে তারা অবশ্যই জবাব দেবে- আল্লাহ (কোর’আন- সুরা আনকাবুত- ৬৩)। আল্লাহ তাঁর নবীকে আবার বোলছেন, ‘এই পৃথিবী এবং পৃথিবীতে যারা আছে তারা কার? যদি তোমরা জানো তবে বলো। তারা বোলবে, ‘সবই আল্লাহর।’ (সূরা মুমিনুন ৮৪-৮৫)।
ইতিহাস ও আল্লাহর সাক্ষ্য, দু’টো থেকেই দেখা যায় যে, যে মোশরেকদের মধ্যে আল্লাহর রসুল প্রেরিত হোলেন তারা আল্লাহকে গভীর ভাবে বিশ্বাস কোরতো অর্থাৎ আল্লাহর ওপর তাদের ঈমান ছিলো। সে সময় বৃহত্তর জনসাধারণকে ধর্মের ব্যাখ্যা দিয়ে ধর্মের কর্তৃপক্ষ সেজে একদল লোক জনসাধারণের মধ্যে ধর্মকে নিয়ে ব্যবসা কোরে নিজেদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ কোরত। যেমন আবু জাহেল ছিল আরবের মধ্যে একজন প্রখ্যাত ‘আলেম’। এজন্য তাকে ডাকা হোত আবুল হাকাম অর্থাৎ জ্ঞানীদের পিতা। বর্তমানেও পৃথিবীর সর্বত্র মোসলেম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও ধর্মকে জীবিকা উপার্জনের পুুঁজি হিসাবে ব্যবহারকারী একটি শ্রেণী রোয়েছেন যারা নিজেদের নামের ‘আলেম’, আল্লামা, মওলানা, মুফতি ইত্যাদি উপাধি ব্যবহার কোরে থাকেন, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও ধর্মীয় যে কোন বিষয়ে তাদের উপর নির্ভর কোরে থাকে। একেবারে মক্কার অবস্থা।
তাহোলে আজ মোসলেম বোলে পরিচিত এই জনসংখ্যাটি (কোন উম্মাহ নয়) যে দীনটাকে পালন কোরে নিজেদের মো’মেন, মোসলেম ও উম্মতে মোহাম্মদী বোলে বিশ্বাস করে এবং মৃত্যুর পর জান্নাতে অর্থাৎ বেহেশতে যাবার আশা করে ঐ জনসংখ্যাটি এবং আরবের ঐ মোশরেকদের জাতিটি যার মধ্যে তাদের হেদায়াহর জন্য আল্লাহ তাঁর রসুল প্রেরণ কোরলেন এ দু’টোর মধ্যে প্রভেদ কোথায়? কথাটা আরও পরিষ্কার কোরছি। বর্ত্তমানের এই দীন পাঁচটি রোকনের (স্তম্ভ) ওপর দাঁড়িয়ে আছে, এ কথায় কোন সন্দেহ আছে কি? অবশ্যই নয়; এবং সেগুলি হোলো- ১) কলেমা, ২) সালাহ (নামায), ৩) যাকাহ, ৪) হজ্ব, ৫) সওম (রোযা)। যারা এগুলির ওপর বিশ্বাস স্থাপন কোরে ওগুলি পালন করেন তাদের বলা হয় মো’মেন, মোসলেম ও উম্মতে মোহাম্মদী। এখন দেখা যাক তদানিন্তন আরবদের সাথে অমিল কোথায়।
১) কলেমা। বর্ত্তমানের এই মোসলেম বোলে পরিচিত জনসংখ্যা বিশ্বাস করে আল্লাহ এক, তিনি উপাস্য, তিনি স্রষ্টা, তিনি রক্ষাকর্ত্তা, তিনি রব অর্থাৎ ভরণ-পোষণকারী, তিনি সর্বশক্তিমান, তিনি পরম দয়ালু, পরম ক্ষমাশীল ইত্যাদি আরও অনেক কিছু। ঐ সময়ের আরবরাও ঠিক এই কথাই বিশ্বাস কোরতো যার প্রমাণ উপরে দিয়ে এসেছি।
২) সালাহ (নামায)। মোসলেম বোলে পরিচিত বর্ত্তমানের এই জনসংখ্যার মত ঐ মোশরেক আরবরাও আল্লাহর ঘর কাবার দিকে মুখ কোরে সালাহ কায়েম কোরতো এ কথা ইতিহাস। আল্লাহর রসুলের ক্রীতদাস, পরে মুক্ত ও তাঁর সন্তান হিসাবে গৃহীত যায়েদকে (রাঃ) খুঁজতে খুঁজতে তার বাপ-চাচারা যখন শুনতে পেলেন যে যায়েদ (রাঃ) মক্কায় মোহাম্মদ (দঃ) নামের একজন লোকের কাছে আছে যিনি আল্লাহর নবী হবার দাবী কোরছেন। এ খবর শুনে তারা উত্তর আরব থেকে মক্কায় এসে লোকজনকে জিজ্ঞাসা কোরলেন- আমরা মোহাম্মদ (দঃ) নামের একজন লোককে খুঁজছি, তাঁকে কোথায় পাওয়া যাবে। লোকজন বললো- নামাযের সময় কাবায় যাবেন, দেখবেন একজন লোক অন্য সব নামাযী থেকে বিচ্ছিন্ন, আলাদা হোয়ে একা নামায পড়ছেন, তিনিই আপনারা যাকে খুঁজছেন তিনি, মোহাম্মদ (দঃ); অর্থাৎ মক্কার মোশরেকরা কাবার দিকে মুখ কোরে জামাতে সালাহ (নামায) কায়েম কোরতো। অবশ্য ঐ সালাহ আল্লাহর নবী এবরাহীমের (আঃ) শেখানো পদ্ধতির ছিলো, শেষ রসুলাল্লাহর পদ্ধতিতে ছিলো না। বর্ত্তমানের সালাতের এই নিয়ম পদ্ধতি পরে এসেছে। আরবের কাফের মোশরেকরা বিকৃতভাবে হোলেও সালাহ (নামাজ) কোরত তার প্রমাণ আল্লাহ পবিত্র কোর’আনেও দিচ্ছেন, “তাদের (জাহেলী যুগের) নামায তো কিছু শিষ দেয়া ও তালি বাজানো ছাড়া কিছুই ছিল না” [সূরা আল আনফাল ৮-৩৫]।
৩) যাকাহ। যে উদ্দেশ্যে যাকাহ দেওয়া অর্থাৎ নিজের উপার্জিত অর্থ থেকে সমাজের অন্য দুঃস্থ, গরিব বা অন্যের প্রয়োজন পূর্ণ কোরতে সাহায্য দেয়া সে অর্থে ঐ মোশরেকরাও তাদের উপার্জিত সম্পদ থেকে বহু দান-খয়রাত কোরতো, এটাও ইতিহাস। তাদের মধ্যে হাতেম তাঈ’র মত আরো অনেক দানশীল ছিলো। আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলের মাধ্যমে সেই অনিয়মিত, ইচ্ছাকৃত দানকে একটা শৃংখলার (উরংপরঢ়ষরহব) মধ্যে এনে এটাকে শতকরা আড়াই (২১/২) ভাগে নিবন্ধন কোরেছেন।
৪) হজ্ব। এ কথা ইতিহাস যে তদানিন্তন মোশরেক আরবরা বছরে একবার কাবাকে কেন্দ্র কোরে হজ্ব পালন কোরতো। হজ্বের প্রচলন শুরু হয় এব্রাহীম (আ:) এর মাধ্যমে। তাদের হজ্বের সময়, মাস, তারিখ, নিয়ম কানুন প্রায় বর্ত্তমানের হজ্বের মতই ছিলো। পার্থক্য হোল, তারা উলংগ হোয়ে হজ্ব কোরত কারণ হাশরের ময়দানে সমস্ত নারী-পুরুষ উলংগ থাকবে। এসলাম এসে দু’টুকরো সেলাইহীন কাপড় দিয়ে সেটাকে শালীন কোরেছে। নবী করীম (দ:) কাফেরদের এই হজ্বের সময় হাজীদের তাবুতে তাবুতে গিয়ে তওহীদের বালাগ দিয়েছেন।
৫) সওম (রোযা)। তখনকার মোশরেকরাও বর্ত্তমানের দীনের মতই রমাদান মাসেই একমাস সওম (রোযা) পালন কোরতো।
তাহোলে যাদের মধ্যে আল্লাহর রসুল তওহীদ অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আসলেন তাদের সাথে বর্ত্তমানের মোসলেম বোলে পরিচিত এই জনসংখ্যার তফাৎ কোথায়?
যদি বলেন যে তারা মুর্ত্তিপূজা কোরতো তবে তার জবাব হোচ্ছে এই যে ঐ মোশরেক আরবরা ঐ মুর্ত্তিগুলোকে আল্লাহ বোলে বিশ্বাস কোরতো না, তাদের স্রষ্টা বোলেও বিশ্বাস কোরতো না, তাদের প্রভু (রব) বোলেও বিশ্বাস কোরতো না। একটু আগেই কোরানের যে আয়াতগুলির উদ্ধৃতি দিয়েছি যেগুলোয় আল্লাহ তাঁর রসুলকে বোলছেন তাদের প্রশ্ন কোরতে, মোশরেকদের জবাব থেকেই, যে জবাবগুলি আল্লাহ স্বয়ং দিচ্ছেন মোশরেকদের পক্ষ থেকে তা থেকেই পরিষ্কার হোয়ে যায়। তাহোলে আরবদের কাছে ঐ মুর্ত্তিগুলি কী ছিলো? তাদের কাছে ঐ মুর্ত্তিগুলি আল্লাহ ছিলো না, তারা বিশ্বাস কোরতো ওগুলি আল্লাহর নিকটবর্ত্তী, ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয়জন। তারা ওগুলির পূজা কোরতো দু’টো কারণে এক) যেহেতু ওগুলো আল্লাহর ঘনিষ্ঠ সেহেতু তারা পূজারীদের পক্ষ হোয়ে কোন ব্যাপারে আল্লাহর কাছে সুপারিশ কোরলে আল্লাহ তা মঞ্জুর কোরবেন। যেমন রোগ শোক থেকে মুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যে সাফল্য, কোন বিপদ থেকে উদ্ধার ইত্যাদি। এ কথার প্রমাণ এই যে, স্বয়ং আল্লাহ বোলছেন তারা আল্লাহ ব্যতীত যার এবাদত করে তা তাদের ক্ষতিও কোরতে পারে না, উপকারও কোরতে পারে না। তারা বলে, ‘এইগুলি আল্লাহর নিকট আমাদের সুপারিশকারী’ (সুরা ইউনুস, আয়াত ১৮)।
দুই) তারা বিশ্বাস কোরতো যে যেহেতু ঐ মুর্ত্তিগুলি, ঐ দেব-দেবীগুলি আল্লাহর ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় কাজেই তাদের পূজা কোরে তাদের সন্তুষ্ট কোরতে পারলে তারা পূজারীদের আল্লাহর সান্নিধ্য (কুরবিয়াহ্) এনে দেবে। এ ব্যাপারেও আল্লাহ বোলেছেন যারা আল্লাহর পরিবর্ত্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করে তারা বলে, ‘আমরা তো এদের পূজা এ জন্যই কোরি যে, এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে এনে দিবে’ (সুরা যুমার, আয়াত ৩) দেখা যাচ্ছে আরব মোশরেকদের মুর্ত্তিপূজার পেছনে দু’টো উদ্দেশ্য ছিলো, একটি দুনিয়াদারী, অন্যটি আখেরাত- অনেকটা আমাদের সমাজে পীরদের কাছে মানুষ যে উদ্দেশ্যে যেয়ে থাকে। সুতরাং ঐ মুর্ত্তিগুলিকে আরবের মোশরেকরা কখনই আল্লাহর স্থানে বসায় নাই। (চোলবে…)
যোগাযোগ: হেযবুত তওহীদ, ফোন: ০১৬৭০১৭৪৬৪৩, ০১৭১১০০৫০২৫
www.hezbuttawheed.com
লেখক সম্পর্কে
- See more at: http://desherpatro.com
No comments:
Post a Comment