DESHERPATRO

Friday, November 6, 2015

৭ নভেম্বরের তাৎপর্য  -মোহাম্মদ ইয়ামিন খান

৭ নভেম্বরের তাৎপর্য 
মোহাম্মদ ইয়ামিন খান
প্রত্যেক জাতির জীবনে এমন কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে যেসব ঘটনা নতুন দিকনির্দেশনা দেয়, চিন্তা-চেতনায় ঘটায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন । জাতি তখন আত্ন-অনুসন্ধান করে, নিজেকে আবিস্কার করে নতুন রূপে । ঠিক তেমনি বাঙালি জাতির জাতীয় জীবনে প্রধান তিনটি ঘটনা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে সেগুলো হলো- ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭৫ সালের সিপাহী-জনতার বিপ্লব । ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতার ফসল ১৯৭৫ সালের ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লব । ৭ নভেম্বর, ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লব । এই জাতির জীবনে এক মাহেন্দ্রক্ষণ এবং যুগান্তকারী ঘটনা । ১৯৭৫ সালের এই দিনে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবে নস্যাৎ হয়ে যায় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ববিরোধী সকল ষড়যন্ত্র, আধিপত্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসন থেকে রক্ষা পায় বাংলাদেশ । সশস্ত্র বাহিনী এবং ছাত্র-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে আনে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমাণ্ডার এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক জেনারেল জিয়াউর রহমানকে । পঁচাত্তরের সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লবের পিছনে যে জিনিসটি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল আর তা হচ্ছে ঐক্য । আমরা জানি, সকল উন্নতি, সমৃদ্ধি এবং প্রগতির মূল হচ্ছে ঐক্য । ঐক্য ছাড়া কোনো অভিষ্ট , কাঙিখত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয় । আল্লাহর একটি প্রাকৃতিক নিয়ম আছে এবং সেই প্রাকৃতিক নিয়ম হচ্ছে ঐক্য অনৈক্যের ওপর সবসময়ে বিজয় অর্জন করে । দশজন ঐক্যবদ্ধ লোক একশ জন ঐক্যহীন লোকের সঙ্গে বিজয়ী হয় । এ চিরন্তন সত্যটি হাজার হাজার বছর আগেও সত্য ছিল হাজার বছর পরেও সত্য হবে । আল্লাহ মুমিনদের উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “তোমরা শক্তভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করো, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না । ” ( সুরা ইমরানঃ ১০৩) আল্লাহ আরো বলেছেন, “ আল্লাহ তাদেরকেই ভালবাসেন যারা গলিত সীসা ঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ হয় । ” [ সুরা ছ্বফঃ ৪] ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় মতভেদ আর রাজনৈতিক হানাহানি করে জাতির ঐক্য নষ্ট করাকে সরাসরি কুফর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আল্লাহর শেষ রাসুল ( সাঃ) । ( হাদিস আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বোখারী, মুসলিম) সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বীনুল ফিতরাত মোতাবেক একমাত্র ঐক্যের গুণে সিপাহী-জনতা বিপ্লব সংঘটিত করেছিল । স্বাধীনতার পর একটি ঐক্যবদ্ধ ও একক জাতিসত্ত্বা সৃষ্টি করে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধশালী জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাঁথা উচু করে দাঁড়ানোর কথা ছিল কিন্তু বিভিন্ন পরাশক্তিগুলো নতুন ষড়যন্ত্র করে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল-মত-পথে বিভক্ত করে পরস্পর কোন্দল, হানাহানিতে লিপ্ত করে দিল । তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটে রাজনীতিক পটপরিবর্তন । ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর জাসদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সৈনিকদের মধ্যে গোপন সৈনিক সংস্থা গঠন করে রাজনীতি শুরু করে । তাদের উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীর অফিসারদের হত্যা করে ক্ষমতা দখল করা । একাশি দিনের মাথায় ৩ নভেম্বর এক পাল্টা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৫ আগস্টের গঠিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে একটি উচ্চভিলাষী দল ক্ষমতা দখল করে । সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে কান্টনমেন্টের বাসভবনে বন্দি করে রাখা হয় । রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে বঙ্গভবনে বন্দি করে রাখা হয় । খালেদ মোশাররফের ওই অভ্যুত্থান দেশে বাকশালী শাসন ফিরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে ভারতপন্থী পদক্ষেপ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল । জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনী তথা সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় । তাকে চেইন অব কমাণ্ড ভাঙ্গার অজুহাত দেখিয়ে বন্দি করা হলে সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয় । সত্য হলো ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হয় । এমতাবস্থায় ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে ঘটে সিপাহী-জনতার ঐক্যবদ্ধ বিপ্লব । এই বিপ্লবে কয়েকজন সহযোগীসহ খালেদ মোশাররফ নিহত হয়েছিলেন । পরদিন ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থানকারী সৈনিকরা ট্যাংক ও সাজোয়া যান নিয়ে বাইরে বেড়িয়ে পড়লো । জনগণ ফুলের মালা দিয়ে হর্ষধ্বনি তুলে বিপ্লবী সৈনিকদের অভিনন্দন জানায় এবং অনেকে ট্যাংকের পিঠে চড়ে বসলো । এমনকি একে অন্যকে আলিঙ্গন করতেও দেখা যায় । রচিত হলো সিপাহী-জনতার বজ্রকঠিন ঐক্য । এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে দিয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তির সমস্ত ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে সিপাহী-জনতা জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে তার হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেয় । ৭ নভেম্বরের মূল চেতনা থেকে বিচ্যুত হওয়ার দরুণ ঐক্যহীনতার মাঝেই ডুবে আছে পুরো জাতি । আমাদের ঐক্যহীনতার সুযোগে চলছে রাজনৈতিক হানাহানি, বিস্তৃত হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়, জঙ্গিবাদের হুমকিতে পড়েছে দেশ এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে সাধারণ মানুষ । অনৈক্যের পরিণামে আজ মুসলিম বিশ্বের কী অবস্থা । আমাদের চেয়েও সমৃদ্ধ দেশ ইরাক-সিরিয়া বিলিন হয়ে গেছে । আমরা চাই না আমাদের এই পবিত্র জন্মভূমি বাংলাদেশ ইরাক-সিরিয়ার ভাগ্য বরণ করুক । যাবতীয় অন্যায়-অবিচার-অসত্য-হানাহানির বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এবং আল্লাহর হুকুমের পক্ষে আমরা ১৬ কোটি লোক যে যেই দল করিনা কেন, আপাতত নিজেদের মধ্যকার সকল মতবিরোধ স্থগিত রেখে, সকল বিভেদ ভূলে দেশ ও জাতির স্বার্থে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং হতে হবে একটি মতের উপর ও একটি নীতির উপর যে আমরা দেশ ও জাতির ক্ষতির হয় এমন কোনো কাজ করবো না, আমরা আর কোনো অন্যায় করবো না ও কাউকে করতেও দিবো না । আমরা আমাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান করতে পারি যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতাম। আমরা যদি ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ জাতি হই তাহলে আমরা হবো বিশ্বের পরাশক্তি । তখন শুধু আধিপত্যবাদী ভারত নয় বরং পৃথিবীর কোনো শক্তি আমাদের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারবে না। ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ধর্মীয়, ঈমানী ও সামাজিক দায়িত্ব থেকে । আর যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ না হই যদি অনৈক্য, রাজনৈতিক হানাহানি, কোন্দল, ষড়যন্ত্র, পারস্পরিক শত্রুতা এবং অন্যায়ের মধ্যে নিমজ্জ্বিত থাকি তাহলে ধ্বংস ছাড়া আর কোনো পথ নেই । আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে মোনাজাত করি এজন্য যে তিনি যেন আমাদের সবাইকে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বোঝার জ্ঞান এবং সত্যের পক্ষে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানোর হিম্মত দান করুক।

No comments:

Post a Comment